এখনও আমার গাঁয়ে হেমন্ত আসে

দিন কয়েক শহরে বাঁচার পর আজ ফের গ্রামের পথে। আমার গাঁয়ের পথে। শহরের যান্ত্রিকতায় আর ব্যস্ততায় টের পাইনি। মনে হয়েছিল বছরের পর বছর শুধু গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত আসে। হেমন্ত যে এখনও নীরবে দরজায় কড়া নাড়ে, তা গাঁয়ে ফিরে বুঝলাম। ছেলেবেলা থেকেই পুজোর ভাসান শেষে মনখারাপের শুরু। আর শুরু হেমন্তের। ঋতুদের মধ্যে ইনি যেন কেমন একটা একঘেয়ে, একাকী, বিরক্তিকর। কলমী, হিমচের পুকুরে তখনও দুগ্গা ঠাকুরের কাঠামো ভাসছে। কাঁধে অস্বস্তির ব্যাগ নিয়ে শীতলা মণ্ডপের রাস্তা দিয়ে আবার টিউশন যাওয়া শুরু। ওই কলমীর গন্ধ তখন বড্ড বিরক্তিকর লাগত। কাঠামোর দিকে তাকালে কী অদ্ভুত মনকেমন। এদিকে আবার অন্য চাপ। ছুটি খুললেই পরীক্ষা। মনে হত যেন দুর… সব শেষ। ভাল্লাগেনা। খেলতে গিয়েও দেখি, কেমন জানি তাড়াতাড়ি দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে। এখনও অফিস ছুটির দিনে ওই কচিকাঁচাদের ভিড়ে নিজের সেই মনখারাপের হেমন্তকে খুঁজে পাই।

আমার গাঁয়ে একইভাবে আজও হেমন্ত আসে। হেমন্ত আসে পাতাদের ঝরে পড়ার সতর্কতা নিয়ে। শীতে যে গাছগুলো ন্যাড়া হয়ে যাবে। তাদের পাতাগুলো এখন থেকেই কেমন জানি হলুদ হতে শুরু করে। হেমন্ত আসে বিঘের পর বিঘে ধানের ক্ষেতে। কার্তিক পেরোলেই অগ্রহায়নে ধান উঠবে। আর সেই ধানের ক্ষেতে অল্প জলে মরাল,পুঁটি, শিঙিদের দাপাদাপি। শিকারের চেষ্টায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বকের দল । আর তাদের শিকার ভেস্তে দিতে তৈরি আমরা। এই তো সেদিন বহুবছর পর বেরিয়ে পড়লাম ছিপ নিয়ে। হ্যাঁ মাছের সংখ্যা কমেছে। তবে সন্ধ্যা নামার আগে ধানের শিষের গন্ধ মেশানো বাতাস হেমন্তের উপস্থিতির জানান দিয়েছে।

একটু পরেই তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বলে উঠল। সেই আলোয় বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে উঠোনে পড়ে থাকা কিছু শিউলি। শরৎ আগেই বাড়ি ফিরেছে। এবার তাদের বাড়ি ফেরার পালা। রাত আরও একটু বাড়লে শুরু ঝিঁঝির ডাক আর জামরুল, সবেদা গাছে বাদুড়ের ঝগড়া। হ্যাঁ বহুবছর পেরিয়ে তাদের ঝগড়া মেটেনি। তাই সমাধান করতে এখনও আমার গাঁয়ে হেমন্ত আসে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশপাশের বাড়িতে পিঠে-পুলির সন্ধান নিতে গেলে পিছু নেয় জোনাকির দল। শিশির ভেজা ঘাস পা ধুইয়ে দেয়। শিশিরের শব্দে আর দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাকে এভাবেই কখন জানি রাত নামে। সকালে এর-ওর চিৎকারে ঘুম ভাঙে। পাশের পাড়ায় কালীপুজোর প্রস্তুতি। খেজুর গাছে কলসী বাঁধতে ব্যস্ত বলাই কাকা। ক’দিন পরেই খেজুরগুড় দিয়ে সরুচাকলি খাব। সঙ্গে পাটালিতো আছেই। অনেক মনকেমনের মাঝে এখনও আমার গাঁয়ে হেমন্ত আসে। আর অনেককিছু শিখিয়ে যায়। কালবৈশাখীর উন্মত্ততা, বর্ষার আবেগ, শরতের বিলাসিতা পেরিয়ে একা বাঁচতে শেখায়। শেখায় ধৈর্য্য ধরতে। শেখায় অপেক্ষা করতে।

  • শোভন

Leave a Reply

Your email address will not be published.