হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে…
“যদি কাগজে লেখো নাম,
কাগজ ছিঁড়ে যাবে,
পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে,
হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে।”
জানি না তিনি কোথায় তাঁর নাম লিখে দিয়ে গেছেন। শুধু এটুকু বলা যায়, এই নাম রয়ে গেছে আর রয়ে যাবে অনন্তকাল পর্যন্ত। এই নাম মান্না দে (Manna Dey) । ১৯১৯ সালে আজকের দিনেই জন্মেছিলেন ভারত তথা উপমহাদেশের এই অনন্য সংগীত শিল্পী।
পূর্ণচন্দ্র দে’র তৃতীয় সন্তান প্রবোধ চন্দ্র দে। গান আর স্কুলের পাঠ প্রায় একই সময়ে শুরু। একসময় গানে গানে মাতিয়ে রাখতেন স্কুলের বন্ধুদেরও। বলাবাহুল্য, কুস্তি, বক্সিং, ফুটবলের পাশাপাশি গান ছিল তাঁর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সূত্রে বাড়িতে প্রায় বিখ্যাত সব গাইয়েরা ভিড় করতেন, সেখান থেকে সংগীতের প্রতি ভালোবাসার জন্ম। ধীরে ধীরে সা রে গা মা পা শেখা। আর তারপর দেখতে দেখতে কাকার প্রিয় মান্না সংগীত ভুবনে সবার প্রিয় মান্না দে হয়ে ওঠেন।
সংগীত শিক্ষার প্রথমের দিকে কাকাকেই গুরু হিসেবে মেনে চলেন। পরে ওস্তাদ দবীর খাঁর সান্নিধ্যে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে সংগীতের খুঁটিনাটি দিক। এরপর ১৯৪২ সালে ফিল্মের গান গাইতে বম্বে পাড়ি দেন। প্রথমের দিকে শচীন দেব বর্মণের সান্নিধ্য পান। পরে ১৯৪৩ তামান্না ছবিতে অভিষেক। বাকিটা ইতিহাস। তবে আজীবন নিয়মানুবর্তিতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই শেষ বয়সে এসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করতেন।
জীবনে কোনও একটি নির্দিষ্ট গানে নিজেকে বেঁধে রাখেননি মান্না দে। সংগীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সংগীতকে ভেঙেছেন নিজের মতো করে, ফের গড়েছেন আর সংগীত সাধনাতেই অতিবাহিত করেছেন গোটা একটা জীবন। সময় পেরিয়েছে আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন ভারতের বিভিন্ন ভাষায় গাওয়া প্রায় ৪ হাজার গান।
প্রতিভাকে তার যোগ্য মূল্য দিতে ভোলেনি সময়। তাঁর জীবনী নিয়ে তথ্যচিত্র হয়েছে। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে থেকে শুরু করে একাধিক জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু কালের নিয়মে এই অনন্য যাত্রাপথেরও ইতি হয়।
২০১৩-এর অক্টোবর জীবনের জলসাঘর থেকে বিদায় নিলেন মান্না দে। কিন্তু তাঁকে ভুলে থাকা মুশকিল। ইচ্ছে করে আরও একবার কোনও এক সোনালি বিকেলে কফি হাউজের সেই আড্ডাটা জমে উঠুক। প্যারিস থেকে ফিরে আসুক নিখিলেশ। ওপার বাংলা থেকে ফিরুক মইদুলও। ক্যানসার থেকে সেরে উঠুক অমল। পাগলা গারদ থেকে নিজের বাড়ি ফিরুক রমা রায়। আর আরও একবার আড্ডা জমে উঠুক। ঠোঁটে চারমিনার আর বিষ্ণু দে কিংবা যামিনী রায়কে নিয়ে চলুক দীর্ঘক্ষণ তর্ক। কেন জানি না তাঁর গানের কথাতেই বারবার বলতে ইচ্ছে করে “আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়।”