সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা

“ছেলেটা খুব ভুল করেছে
শক্ত পাথর ভেঙে ,
মানুষ ছিল নরম কেটে ছড়িয়ে দিতে পারত……..
পথের হদিস পথ জানে, মতের কথায় মত্ত
মানুষ বড় সস্তা কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত।

সত্যি ছেলেটি আলাদা, ইনি কাব্য কাননের ছকে বাঁধা পথের পথিক নন।একের পর এক পাথর রূপ ভাবনার পরিচিত আদলকে ভেঙে যেন আজীবন নিজের পথ তৈরি করে গেছেন,প্রায়শই মাতালের মুখোশ আঁটা এক দার্শনিক যিনি ওলট পালট করে গেছেন জীবনের ধরা বাঁধা ছককে, মানবিক মূল্যবোধকে , সমকালীন কাব্যজগতকে দিয়ে গেছেন এক অনন্য মাত্রা যার মূল্যায়ণ তিনি নিজেই- কবি “শক্তি চট্টোপাধ্যায়”।

রবীন্দ্র-পরবর্তী কাব্য জগতে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের উজ্জ্বল উপস্থিতি ।একের পর এক আসেন বুদ্ধদেব বসু,অমিয় চক্রবর্তী,বিষ্ণু দে,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এঁরা নিজ নিজ রচনাগুনে বাংলা কাব্যজগৎকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেন ব্যতিক্রমী- “যেতে পারি ,কিন্তু কেন যাবো?”
১৯৩৩ খ্রিঃ ২৫শে নভেম্বর চব্বিশপরগণার বাহারু গ্রামে তাঁর জন্ম। সমকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা যার প্রতিফলন ঘটে তাঁর কবিতার মধ্যে, একের পর এক সৃষ্টি করলেন – ‘অবনী বাড়ি আছো’, ‘চাবি’, ‘আনন্দভৈরবী’ ,’বিরহে যদি দাঁড়িয়ে ওঠো’, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’। চেনা শব্দ গুলো নিয়ে অচেনা ছকে কি যেন সব গড়ে তুললেন যেন অনেক প্রশ্ন রেখে গেলেন –

“ অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া অবনী বাড়ি আছো?”

‘কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছ “, কক্সবাজারে সন্ধ্যা, ও ‘চিরপ্রণম্য’ ‘অগ্নি’ কিংবা ‘বিষের মধ্যে সমস্ত শোক ‘ -আমরা শুধু মুগ্ধ হয়ে অনুভব করে গেলাম, কখনো পেলাম বিষাদ আবার কখনো জেগে ওঠবার ঐকান্তিক ইচ্ছে।
তবে কাগজ কলমের মধ্যেই এই সাহসিকতা সীমাবদ্ধ ছিলনা সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তখন পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ চলছে একাত্তর সাল তার আগে থেকেই উনি বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেন। বাংলা দেশের কবিদের কবিতা নিয়ে এক কবিতা সংকলন বার করেন। বাংলা দেশী কবিদের আনা তাদের সম্মান দেওয়া তাদের কাছে যাওয়া তাদের সাথে একাত্ম বোধ করা … এক কবিতায় বলে উঠেছেন –

“মরো কিন্তু মেরে মরো
এবং উদ্ধার করো ঘর
নিশ্চিত রয়েছি পাশে
আমি তোর জন্মসহোদর”

রবীন্দ্র সঙ্গীত ভালো গাইতেন রাজেশ্বরী দত্ত দেবব্রত বিশ্বাস কনক দাশের গান খুব ভালোবাসতেন।হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের সাথে প্রথমের দিকে জড়িয়ে থাকলেও পরে সরে আসেন ।কবির কথায় এই আন্দোলন তার উদ্দেশ্য ভাবনা চিন্তা থেকে দূরে সরে গিয়ে পরের দিকে অশ্লীলতায় ভরে ওঠে। কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে আজীবন যুক্ত থাকলেও কখনও সক্রিয় রাজনীতি করেননি।সত্যি তিনি দুঃসাহসিক যখন তিনি আপন ছন্দে লিখেছেন তখনও, আবার শেষের দিকে যখন আর লেখা নেই তখনও নির্দ্বিধায় লিখে চলেছেন –

“কবি হয়ে দাঁড়াবার আর কোন সাধ নেই মনে
শেষ হয়ে গেছে লোকটা,এও শুনে লাগে আঁচড়
গায়ে সব শুনে শুই পাশ ফিরে সম্ভ্রান্ত বিশ্রামে।“

প্রতিদিন বিশেষ করে দুপুর বেলায় লেখার অভ্যাস ছিল। তবে একসময় যখন আর লিখতে পারতেন না তখন তাঁর কবিতাতে বলেছেন – শব্দ বেহিসাবীর মতন খরচ করেছি বলেই শব্দ আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে । ছবি আঁকা নাটক সম্বন্ধে উনার এক আলাদা ভাবনা ছিল।উমাপ্রসন্ন, শক্তি বর্মন পূর্ণেন্দু পত্রী এদের সাথে কফি হাউস আর অ্যাকাডেমিতে জমে উঠত আড্ডা ।
শেষের দিকে পাঁচ বছর নার্ভের অসুখে ভুগেছিলেন। স্ত্রী মীনাক্ষী দেবীর কথায় বড় খাম খেয়ালী ছিল লোকটা হঠাৎ হঠাৎ চলে যেত কিছু না বলেই, দু তিন কাটিয়ে ফিরে আসতো শেষ বারও গেলো আর ফিরল না … এভাবেই আমরা হারিয়েছিলাম কাব্য লক্ষীর এই সন্ন্যাসী স্রষ্টাকে –

অসুখ এক উদাসীনতা, অথচ সামাজিক
লোকটা কিছু রহস্যময়, লোকটা কিছু কালো
নিজের ভালো করেনি, তাই, অন্যে ক’রে ভালো
সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা কিছুটা নির্ভীকই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.