সামনে রাখা লজেন্স, কিশমিশ; কোষ্ঠি-ঠিকুজি বিচারে ব্যস্ত শরদিন্দু বাবু
বাঙালির ড্রয়িং-রুম থেকে সেলুলয়েডের পর্দা। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। বাংলা সাহিত্যে রহস্য-রোমাঞ্চের মেলবন্ধনের কারিগর। তা সে বরদার কেরামতি হোক কিংবা ব্যোমকেশের চুলচেরা বিশ্লেষণ। তাঁর লেখনীর মুন্সিয়ানা বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে তাঁকে অমর করে দিয়েছে। তবে আজ আলাপ করা যাক এক আলাদা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ইনি হলেন জ্যোতিষ শরদিন্দু। তৎকালীন সময়ে কোষ্ঠি-ঠিকুজি বিচারে লেখক মহলে বেশ খ্যাতি ছিল চিরস্মরণীয় এই সাহিত্যিকের।
শরদিন্দু বাবুর নিজের লেখা ডায়েরি ছাড়াও তৎকালীন সময়ের নানা লেখা ও বহু সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণে এই জ্যোতিষ চর্চার উল্লেখ মেলে। সত্যি বলতে, সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি জ্যোতিষ চর্চা ছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেশা। শুধু নিজের পরিবারের সদস্য নয় সেই সময়ের নানা লেখক, কবিদেরও কোষ্ঠি করেছিলেন তিনি। তালিকায় সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো লোকজনও ছিলেন। একদিন কলকাতায় বেঙ্গল পাবলিশার্সের অফিসে গল্পে মেতে শরদিন্দু বাবু। সেখানেই সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। জ্যোতিষ চর্চার কথা শুনে নিজের জন্ম সময় দিয়েছিলেন সুনীতি বাবু। কোষ্ঠিও করিয়েছিলেন।
শরদিন্দুবাবুর লেখার টেবিলের সামনে দিকে থাকত নানারকম কৌটো। কোনওটায় লজেন্স, কোনওটায় আখরোট, কোনওটায় আবার কিশমিশ। লেখার সময় হাতের সঙ্গে সঙ্গে মুখও চলত। আর এর পাশাপাশি লোকজনের ভবিষ্যতের ছকও কষে ফেলতেন। একসময় দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলা অঞ্চলে থাকতেন তিনি। সেখানে সাহিত্যিক বন্ধুদের নিত্য যাতায়াত ছিল। প্রতুল চন্দ্র গুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী,গজেন্দ্রকুমার মিত্র,বিমল মিত্র আরও অনেকে। এদের অনেকেরই ঠিকুজি তৈরি হয়েছে ব্যোমকেশের স্রষ্টার হাতে। শরদিন্দুর পরামর্শে নীলা আংটি ধারণের পর নীহাররঞ্জন বাবুর খ্যাতি বাড়তে থাকে। শোনা যায়, আংটি ধারণের পর সাহিত্য থেকে নাট্যমঞ্চ সর্বত্র নীহাররঞ্জনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
মিত্র-ঘোষের ভানুবাবুর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এক দারুণ স্মৃতি। প্রায়শই বড় বড় লেখকদের ঠিকুজি দেওয়া-নেওয়ার কাজ করতেন ভানু বাবু (সবীতেন্দ্রনাথ রায়)। স্মৃতিচারণে সবীতেন্দ্রনাথ রায় বলছেন, “একদিন শরদিন্দুবাবু বললেন ভানু তুমি সকলের ঠিকুজি নিয়ে আস, দিতে যাও ; তোমারটা কখনও দেখাওনি। আমি বললাম আমি সাধারণ মানুষ। আপনি নামজাদা মানুষের ঠিকুজি দেখেন, তাই আর দিইনি।” শরদিন্দু বাবু বললেন, “আরে এটা তো আমার হবি। এখানে নামজাদা- অনামজাদা কিছু নেই। এরপর তুমি যখন আসবে, তোমার কোষ্ঠিপত্র নিয়ে আসবে।”
সবীতেন্দ্রনাথ রায়ের কথায়, পরের বার যাওয়ার সময় আমার ঠিকুজি নিয়ে গেলাম। মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। এবার শরদিন্দুবাবুর কাছে যেতেই তিনি হেসে বললেন, ভানু, আমি এক দারুণ সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি। প্রায় ব্যোমকেশের মতো। আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতে উনি বললেন, তোমার এ কোষ্ঠিপত্র তৈরি হয়েছে কাশীতে। আমি বললাম, হ্যাঁ আমার এক সম্পর্কিত- কাকা কাশীতে থাকতেন। তিনি করিয়ে দেন। শরদিন্দু বাবু বললেন তাইতো উনি ধরে নিয়েছেন তোমার জন্ম কাশীতে। তোমার শুক্রলগ্ন ধরে কোষ্ঠী করেছেন। কিন্তু তোমার কন্যালগ্ন। রাশি মীন ঠিকই আছে। আমি হতাশ হয়ে বললাম, তাহলে ওই কোষ্ঠিপত্রটাই ভুল? উনি বললেন, অত হতাশ হওয়ার কারণ নেই। তোমার ছক তৈরি করে ভবিষ্যৎ গণনা একটা করে রেখেছি। আমি কৌতুহূল চেপে চুপ করে শুনছি। শরদিন্দুবাবু বললেন ১৯৬৫ সালে তোমার বাড়ি হবে। ১৯৭০ সালে বিবাহ। দুটি কন্যার জন্ম। অমুক সালে বিদেশ যাত্রা ইত্যাদি। আমি বললাম, এসব তো গল্পকথা বা রূপকথা শোনাচ্ছে। শরদিন্দু বাবু মৃদু হেসে বললেন জানাতে ভুলো না, যখন যা হবে। সেটা ১৯৬২ সালের কথা। নিজের বাড়ি তখন কষ্টকল্পনা মাত্র। তবু ১৯৬৫ সালে যখন বাড়ি হল। গৃহপ্রবেশ হল। শরদিন্দুবাবুকে চিঠি দিয়ে আশীর্বাদ চেয়েছিলাম। শরদিন্দুবাবু আশীর্বাদ দিয়ে উত্তর দিলেন, পরেরগুলিও ঠিক ঠিক হবে দেখবে। তবে আমাকে জানাতে ভুলো না। বিয়ের মিষ্টি তো খাবই। দুঃখের বিষয়, সে মিষ্টি তাঁকে খাওয়ানো যায়নি। তার আগেই তিনি পরপারে যাত্রা করেছেন।
(তথ্য ঋণ – লেখকের কাছাকাছি, সবীতেন্দ্রনাথ রায়)