সংসারের টানাপোড়েন, একাকীত্ব ; জীবনপথে বারবার হোঁচট খাওয়া মহিলাই দেশের ব্যালিস্টিক মিসাইলের কারিগর
শশীকলা সিনহা। অনেকেই তাঁকে BMD (ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স) বলে জানে। হ্যাঁ, একটু অবাক লাগলেও সত্যি। দেশের ব্যালিস্টিক মিসাইলের নেপথ্যে রয়েছেন এই মহিলা। তবে এই সাফল্যের নেপথ্যে এক লম্বা লড়াইয়ের কাহিনী রয়েছে। রয়েছে একাকীত্ব। রয়েছেন হার না মানা দুই সন্তানের মা।
তামিলনাড়ুর মাদুরাইতে জন্ম শশীকলার। ভারতীয় সেনার মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার পোস্টে ছিলেন বাবা। চাকরি সূত্রে বাবাকে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে ছোট্ট শশীকলাও দেশের নানা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে। সেই সূত্রে স্কুলজীবন কেটেছে হায়দ্রাবাদে। অঙ্ক প্রিয় বিষয় ছিল শশীকলার। শশী যে একটু অন্যরকম, তা ছোটো থেকেই বোঝা গিয়েছিল। ক্লাসের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে কোথাও যেন অনেকটা এগিয়ে শশী। প্রথমে সেন্ট ফ্রান্সিস কলেজ, পরে ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কেরিয়ার শুরু।
এরপর DRDO-তে চাকরি শুরু করেন শশীকলা। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই সেই চাকরি ছেড়ে দেন। মাস্টার ডিগ্রি করার জন্য IIT খড়গপুরে পড়তে চলে যান। এরপর সোসাইটি অফ মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় শশীকলার। স্বামী নৌ সেনা আধিকারিক ছিলেন। তখন তিনি সন্তানসম্ভবা। জীবনের প্রথম সন্তান আসছে ঘরে। তাই চাকরি ছেড়ে দেন মা শশীকলা। ১৯৮৯ সালে মেয়ে পবিত্রা জন্ম নেয়। কয়েক বছর পেরিয়েছে। এবার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম নেওয়ার সময়। এমন সময় এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় স্বামীর। দুই মেয়েকে নিয়ে শশীকলা তখন একদম একা। মেয়েদের বড় করে তুলতে হবে। সংসারের দেখভাল করতে হবে। তবে লড়াই থামেনি শশীকলার।
১৯৯৭ সাল। DRDO হায়দ্রাবাদের রিসার্চ সেন্টার ইমারতে (RCI) কনট্রাক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ফের কাজ শুরু করেন। ২০০১ সালে ফুল টাইম সায়েন্টিস্ট পদে প্রমোশন হয়। ফ্লাইট ভেইকেলস, RF সিকারস, ব়্যাডমস, ব়্যাডার টেকনোলজি, মিসাইল সিস্টেম, গাইডেড উইপন সহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। তখন ব্যালিস্টিক মিসাইলের জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল ভারত। আর DRDO-এর ল্যাবে একজন জেদি মহিলা ব্যালিস্টিক মিসাইল নিয়ে গবেষণা করতে ব্যস্ত। গবেষণার মাঝে ছবি আঁকা, স্কেচে নিজের মতো করে অবসর খুঁজে নিতেন। বছর দশেক ধরে নিরলস পরিশ্রম।
ইতিমধ্যেই একদশক কেটেছে। ২০১২ সালে মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের ডিরেক্টর হন তিনি। ২০১৬ সাল। পাঁচটি S-400 অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট মিসাইল সিস্টেম সরবরাহের জন্য BRICS-এ রাশিয়ার সঙ্গে IGA চুক্তি সাক্ষরিত হয়। পরের বছর ২০১৭ সালে দেশের নানা জায়গায় মিসাইল টেস্ট শুরু হয়। ২০২১ সাল। আজ দেশের সাধারণতন্ত্র দিবস। আজ ভারত সেই সমস্ত দেশের মধ্যে একটি, যার নিজস্ব ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স রয়েছে। আর এই ঐতিহাসিক সাফল্যের নেপথ্যের কারিগর শশীকলা সিনহা।