কখনও অন্ধ, কখনও কাজের মেয়ে ; ৮০,০০০ রহস্যের সমাধান করেছেন এই মহিলা

সালোয়ার কামিজে দেখলে তাঁকে আর পাঁচটা সাধারণ ঘরের মেয়ের মতোই লাগে। সহজ সরল দৃষ্টি, কথাবার্তায় বোঝার কোনও উপায় নেই যে ইনিই দেশের প্রথম মহিলা প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। নাম রজনী পণ্ডিত। সুদীর্ঘ গোয়েন্দা জীবনে ৮০,০০০ কেসের সমাধান করে ফেলেছেন। তবে অনুসন্ধান এখনও জারি। কখনও অন্ধ, কখনও কাজের মেয়ে কখনও বা অন্তঃসত্ত্বার ছদ্মবেশে এখনও করে চলেছেন সত্যের অনুসন্ধান।

১৯৬২ সালে মহারাষ্ট্রের থানে জেলার পালঘরে জন্মগ্রহণ করেন রজনী। শৈশব থেকেই নানা অনুসন্ধানমূলক চরিত্র, গল্প, থ্রিলার উপন্যাস পড়ার প্রতি টান ছিল তার। মুম্বইয়ের রপারেল কলেজে মারাঠি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। সালটা ১৯৮৩ । সেইসময় একটি ঘটনা ঘটে। রজনীর কলেজের এক সহপাঠী পতিতাবৃত্তির কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। বন্ধুর আচার আচরণেই সন্দেহ হয় রজনীর। প্রথমে ওই মেয়েটির বাবা-মাকে জানায় রজনী। কিন্তু সে কথায় কেউ বিশ্বাস করেনি। তা বলে কি আর প্রতিভাকে রোখা যায় ? নিয়তি বোধহয় অন্যকিছু চেয়েছিল। তাই খোঁজার জেদ পিছু ছাড়েনি রজনীর। সেই শুরু। ওই বন্ধুর পিছু নিয়ে নানা ছবি জোগাড় করে শেষমেশ সত্যিটা সামনে আনে রজনী এবং সেই চক্র থেকে বন্ধুকে উদ্ধার করে।

এক সাক্ষাৎকারে রজনী পণ্ডিত বলেন, “ছোটোবেলা থেকে বরাবরই সবকিছুতে কৌতূহল ছিল আমার। বাবা CID-তে ছিলেন। বাবার কাছ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্তের কায়দাটা অনেকটাই শিখেছি। ২২ বছর বয়সে কাজ শুরু করি।” পেশাদার ডিটেক্টিভ হিসেবে কলেজ জীবনেই প্রথম কেসের সমাধান করেছিলেন রজনী। ফার্স্ট ইয়ারে পার্ট টাইমে একটি অফিসের ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সেখানেই এক মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই মহিলা কথায় কথায় জানান, তার বাড়িতে প্রায়শই চুরি হয়। এবং তিনি তার জামাইকে সন্দেহ করছেন। তবে কোনও প্রমাণ নেই। তাই রজনীকে তদন্ত করার ভার দেন তিনি। বেশ কয়েকদিন নজরদারি চালানোর পর শেষমেশ চোর ধরা পড়ে। রজনী জানান, চোর জামাই ছিলেন না ওই মহিলার ছেলেই বাড়ি থেকে চুরি করতে । পরে ওই মহিলার ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আসল সত্যিটা বেরিয়ে আসে। সেটাই ছিল প্রথমবার টাকা নিয়ে রহস্য সমাধান করেন।

এরপর থেকে রজনীর নাম ধীরে ধীরে ছড়াতে থাকে। কথাটা বাবার কানেও যায়। বাবা মেয়েকে বোঝান, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ । কিন্তু এটাই ছিল মেয়ের নেশা। রজনীর কথায়, “বাবা যখন পারে, আমিও পারব।” রহস্য অনুসন্ধানই হয়ে ওঠে রজনীর নেশা। সংসার করাও হয়ে ওঠেনি তাঁর। রজনীর কথায়, “আমি কখনও পরিবার শুরু করার কথা ভাবিনি। কারণ আমার নেশা আর পেশা এই তদন্তের কাজকেই খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করে নিই।”

১৯৯১ সালে নিজের একটি এজেন্সি খোলেন। নাম দেন রজনী পণ্ডিত ডিটেক্টিভ সার্ভিস। পরে এই এজেন্সির নাম হয় রজনী ইনভেস্টিগেশন বিওরো। তারপর থেকে খুন, নিখোঁজ, প্রতারণা, কত রহস্যের সমাধান। দেশে, বাইরে নানা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও কাজের মেয়ে, কখনও অন্ধ, বোকা মহিলা, কখনও অন্তঃসত্ত্বার ছদ্মবেশে একের পর এক রহস্য সমাধান। ২০১০ সালে মুম্বইয়ের মহিমে একটি নতুন অফিস তৈরি করেন তিনি। যেখানে ৩০ জন গোয়েন্দা কাজ করেন। মাসে মোট ২০ টি কেস নেয় এই এজেন্সি।

জীবনের অন্যতম কঠিন কেস নিয়ে কথা বলতে বলতে রজনী দেবী বলছিলেন, “আমার জীবনের একটা অন্যতম কেস ছিল একটা খুনের রহস্য। এই ঘটনায় এক মহিলার স্বামী ও ছেলে একসঙ্গে খুন হন। কিন্তু বোঝা যায়নি কে খুন করেছে । কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেসটা আমার কাছে আসার পর বহু গবেষণা চালাই। তারপর ওই বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে ঢুকি। প্রাইম সাসপেক্ট ওই মালকিনের সঙ্গে থাকা শুরু করি। একবার মালকিন অসুস্থ হয়ে পড়লে ওর খুব সেবা করি। ধীরে ধীরে আস্থা অর্জন করি ওই মহিলার। কিন্তু তিনি একবার আমার রেকর্ডারের সাউন্ড পেয়ে যান, তারপর থেকে ধীরে ধীরে সন্দেহ করতে শুরু করেন। আমাকে খুব একটা বাইরে যেতে দিতেন না। এরই মাঝে ওই বাড়িতে একটি লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করি। কথাবার্তা শুনে ধীরে ধীরে বুঝতে পারি এই সেই লোক যে মালকিনের কথায় টাকার বিনিময়ে খুন করেছে। এরপর ফের একদিন ওই খুনি মালকিনের সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। আমি ছুরি দিয়ে আমার পা কেটে দিই, আর কাঁদতে কাঁদতে বলি আমায় বাইরে যেতে হবে ব্যান্ডেজ করাতে । তারপর বাইরে বেরিয়ে সামনের STD বুথ থেকে আমার ক্লায়েন্টকে ফোন করি। পুলিশ নিয়ে আসতে বলি। শেষমেশ ওই মহিলা আর ওই সুপারি কিলারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এপর্যন্ত ৮০ হাজারের বেশি রহস্য উদঘাটন করেছেন রজনী। ফেস বিহাইন্ড ফেস এবং মায়াজাল নামে দুটি বইও লিখেছেন। তাঁর জীবনীর উপর ভিত্তি করে দিনকর রাও লেডি জেমস বন্ড নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। ঝুলিতে রয়েছে বহু পুরস্কার। তবে এসবের পাশাপাশি জীবনে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কী ? এই ঝুঁকি, বিপদগুলোকেই উপভোগ করেন তিনি । “বেশ কয়েকবার অনেকে হুমকি দিয়েছে। কিন্তু আমার কাজ ও লক্ষ্য স্থির এবং পরিষ্কার । তাই কখনও দমে যায়নি।” বলে চলেছিলেন দেশি শার্লক রজনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.