জুয়া, জেল, একাকীত্ব ; জীবন পোড়া ছাই থেকে বারবার জন্ম নেওয়া ফিনিক্সের নাম গালিব
রঁগো মে দৌড়নে ফিরনে কে হাম নঁহী কায়েল
যব আঁখ সে হি নহ টপকা তো ফির লহু ক্যা হ্যায় ?
কিছু শব্দের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা এক দার্শনিক। কী যেন সব বলে গেলেন। আর জীবনকে বারবার দাঁড় করালেন কিছু নির্মম সত্যের সামনে। কখনও বা সব জেনেও আশ্রয় নিলেন শব্দের আড়ালে। মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান। জীবন পোড়া ছাই থেকে বারবার জন্ম নেওয়া এক ফিনিক্স।
জুয়া-জেল-জীবন
১৮০২ সালে মারা যান আবদুল্লাহ বেগ খান। ছেড়ে যান দুই ছেলে ও এক মেয়েকে। ১৭৯৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মেছিল আবদুল্লাহ বেগ খানের বড় ছেলে আসাদুল্লাহ বেগ খান। চাচার পরিবারে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিলেন সাহিত্যের এক বিস্ময়। সামান্য ভাতায় সংসার চলছিল। আরবি-ফারসি ভাষা এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে ধীরে ধীরে জ্ঞান লাভ করতে থাকে ছোট্ট আসাদুল্লাহ। ১৮১০ সালে ইলাহি বক্স খানের কন্যাকে বিয়ে করেন গালিব। সেই সূত্রে আগ্রা ছেড়ে দিল্লিতে থাকা শুরু করেন। প্রথম জীবনে আসির, রুমি সহ বেশ কয়েকজন ফার্সি কবিকে অনুকরণ করেন। পরে অবশ্য তা থেকে বেরিয়ে আসেন। লখনউতে আরও তীক্ষ্ণ হয় তার সাহিত্য চর্চা। প্রেমিকার মৃত্যু, মদ-জুয়া, জেল। জীবনের নানা অধ্যায়কে শব্দের আড়ালে থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৮৪১ সালে ১১০০টি শায়ের নিয়ে প্রকাশ করেন প্রথম দিওয়ান। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন গালিব। কিন্তু অর্থকষ্ট পিছু ছাড়েনি। জুয়ার নেশায় একবার তিনমাসের জেল হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে বাহাদুর শাহের দরবারে লেখার কাজ নেন। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে আবার সবকিছু বদলে গেল। পরে সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে একটি বইও লেখেন।
শহর পুড়ছে, মির্জা হারাচ্ছে একের পর সন্তানকে, ভাইকে বন্ধুকে
সিপাহি বিদ্রোহ, ইংরেজদের পুর্নদখল, অজানা মহামারি, দুর্ভিক্ষ। গালিবের চোখের সামনেই যেন অস্পষ্ট হয়ে আসছে তাঁর প্রিয় শহর। অস্পষ্ট হয়ে আসছে তাঁর মহল্লা বাল্লিমারানের সংকীর্ণ পথ। রাস্তার পাশে চাপ চাপ রক্ত। যুদ্ধ, মহামারি কেড়ে নিচ্ছে প্রিয়জনদের। বাতাসে কীসের বিষ ছড়িয়েছে। কবর খোঁড়ার লোকও নেই। এমন সময় ভোরবেলা শুনতে পেলেন অজানা জ্বরে খেয়ে ফেলেছে তাঁর ছোটো ভাই মির্জা ইউসুফকে। সন্ধ্যায় বন্ধু হুসেনের বাড়ি গেলেন। দেখলেন কিছু চেনা লাস বড্ড অচেনা ভাবে পড়ে। পর পর সাত সন্তানের মৃত্যু। চেনা শহর থেকে যেন পালিয়ে বাঁচতে চান গালিব।
বছর দেড়েকেই আপন হয়ে ওঠে কলকাতা
অল্প সময়ের মধ্যেই ভালবেসে ফেলেছিলেন শহরটাকে। আম খেতেও বড্ড ভালোবাসতেন। আসলে বিচার চাইতে কলকাতা আসা তাঁর।
নাসরুল্লাহ খানের মৃত্যুর পর সরকার থেকে পরিবারের জন্য দশ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরে এক সংশোধন সেই টাকার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এর জেরে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা করে পেতে শুরু করে গালিবের পরিবার। প্রাপ্য টাকা আদায় করতে ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৮২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এলাহাবাদ, মুর্শিদাবাদ হয়ে পৌঁছালেন কলকাতায়। পরে গভর্নর জেনারেলের কাছে আবেদন জানালেন। কিন্তু পরিবারের প্রাপ্য টাকা আর মেলেনি। ১৮২৯ সালে কলকাতা থেকে বিদায় নেন গালিব। কলকাতায় এসে ১৩৩ রামদুলাল সরকার স্ট্রিটের লাল তেতলা বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। আজ সবই আবছা স্মৃতি।
শব্দের আড়ালে জীবনকে লিখে গিয়েছেন
“উমর ভর গালিব ওহি গলতি করতা রাহা
ধুল চেহরে পর থি ওর আয়না সাফ করতা রাহা।”
ফার্সি সাহিত্যের পাশাপাশি উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ তিনি। কবিতা জুড়ে শুধু জীবন, ছোটো ছোটো সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যর্থতা আর চাওয়া-পাওয়া বলা না পাওয়ার এক অদ্ভুত হিসেব। কালক্রমে সেটাই হয়ে উঠল অমূল্য সম্পদ। আড়ম্বর থেকে বহু দূরে গিয়ে ধর্মকে দেখেছেন আন্তরিকতায়, আত্মোপলব্ধিতে। সেই ভাবনাও ফুটে উঠেছে লাইনের পর লাইনে।
নিয়তির লেখক গালিব
জীবনকে নিয়ে লিখতে লিখতে নিয়তি কড়া নাড়ল গালিবের দরজায়। এবার যাওয়ার পালা। শরীর তখন ভাঙতে শুরু করেছে। ১৮৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসার শহরে, ওই পরিচিত মহল্লার ভিড়ে কোথাও একটা হারিয়ে যান গালিব।
নিজামুদ্দিন আউলিয়ার পাশেই গালিবের সমাধি। আজও মাটির নিচে শুয়ে হয়তো কোনও গূঢ় হিসেবে মগ্ন তিনি। হয়তো খানিক উদাসীনতায় জীবন নিয়ে কাঁটাছেড়ায় ব্যস্ত।