অন্যরকম

পদ্মশ্রী সিন্ধুতাই, একসময় অনাথদের খাওয়াতে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করেছেন

সিন্ধুতাই সপকল (sindhutai sapkal)। লোকে তাঁকে মহারাষ্ট্রের মাদার টেরেসা বলেও ডাকে। প্রায় ১৫০০ সন্তানের মা। সমাজ যাদের স্বীকৃতি দিতে চায় না, নিয়তির অদ্ভুত পরিহাসে কোনও পরিচয় ছাড়াই যারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, তাদের মায়ের স্নেহ, ঘুমোনোর কোল আর মুখে অন্ন তুলে দেন এই সাদামাটা বয়স্ক মহিলাটি। তাঁর ছেলে-পুলে আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন। কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার। নিজেরও একাধিক আশ্রম রয়েছে। তাঁর জীবনের উপর তৈরি মারাঠি সিনেমা ‘মি সিন্ধুতাই সপকল’ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। নিজেও বহু জাতীয়, আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। এবার পেলেন পদ্মশ্রী। কিন্তু এর পিছনে অনেক সংগ্রাম লুকিয়ে। লুকিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম আর মানব সেবায় উৎসর্গীকৃত একটি প্রাণ।

মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার এক গরিব ঘরে জন্ম সিন্ধুর। গরু চরানো ছিল পরিবারের পেশা। পড়াশোনা একরকম বিলাসিতার সমান। তবে গরু চরানোর অজুহাতে মেয়েকে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিলেন বাবা। স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণীর পর আর পড়া হয়নি। বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় সিন্ধুর। দশ বছরের সিন্ধুর বিয়ে হয় ২০ বছরের শ্রীহরি সপকলের সঙ্গে। মাঠ থেকে গোবর কুড়োনো, গরু চরানো, এই সব কাজ করেই সংসার চলত। তখন সিন্ধু গর্ভবতী। স্বামী শ্রীহরি গর্ভবতী স্ত্রীকে গোয়ালে ফেলে পালায়। মারধরও করে। গোয়াল ঘরেই সন্তানের জন্ম দেয় সিন্ধু। পাথর দিয়ে নাড়ি কেটে জীবনের সংগ্রামকে ধীরে ধীরে চিনতে শেখে। সে যাত্রায় প্রাণ বাঁচলেও মাথাগোঁজার জায়গা হয়নি। আসলে নিয়তি যে অন্য কিছু ভেবেছিল। সিন্ধু কোনও এক সংসারের নয়। কোনও এক বাচ্চার মা নয়। সে যে সবার।

শুরু হয় পথচলা। বলা ভালো পথে পথে বিপদ, প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে সরিয়ে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা। দিনের বেলা গান গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে শুরু করেন। রাতে আশ্রয় নেন শ্মশানে। ট্রেনে চড়ে বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে গান গেয়ে নিজের ও মেয়ে মমতার খরচা চালাতে থাকেন। কিন্তু এ কী ! চারদিকে যে অনেক মমতা ঘুরছে। আর তাদের কাছে কোনও সিন্ধুও নেই। শুরু হয় অনাথ শিশুদের আপন করে নেওয়ার সংগ্রাম। নিজে ভিক্ষে করে তাদের খাওয়াতে শুরু করেন। তাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। ধীরে ধীরে সিন্ধুর নাম ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন এগিয়ে আসেন। সিন্ধু হয়ে ওঠেন সিন্ধুতাই।

শোনা যায়, পরের দিকে স্বামী ফিরে এসেছিলেন। ক্ষমা চান সিন্ধুর কাছে। কিন্তু সিন্ধু যে এখন সিন্ধুতাই। এখন তিনি সবার মা। সারাদিন সন্তানদের দেখভাল করতেই কেটে যায়। কখনও পুরস্কারের অর্থ দিয়ে জমি কিনছেন। কখনও নতুন অনাথ আশ্রম গড়ে তুলছেন। আসলে ওই সহজ সরল মুখ আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চোখ জুড়ে এক অদ্ভুত সংকল্প। সংকল্প মানবতার। সংকল্প এক সুন্দর পৃথিবীর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *