রুদ্ধশ্বাস, বিরাট, বাকিটা ইতিহাস…
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া। মেলবোর্ন। শব্দগুলি কখন যেন মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে। ওই তো পয়েন্টের দিকে গ্যালারিতে বসে থাকা প্রেমিকা খানিকটা অসহায়ভাবে প্রেমিকের হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে। হার্দিক, সূর্য, রোহিতরা দারুণ দুশ্চিন্তায়। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ যেন বিশ্বকাপ ফাইনালে পরিণত হয়েছে। হবে না-ই বা কেন ? ২২ গজে তখন চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান। বোধহয় তাই মেলবোর্নের সেই দুশ্চিন্তা, জেতার তীব্র ইচ্ছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে করাচি, লাহোর, দিল্লি, কলকাতা থেকে শুরু করে সীমান্তের কোনও এক গাঁয়ের টিভি ঘরে ঢুকে পড়েছে। অটোওয়ালা যাত্রী তুলে নিয়েছে। কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দেয়নি। যাত্রীরাও কেউ কিছু বলছে না। ফোনে মুখ গুঁজে। একজন অবশ্য বলেছিল। চালকের উত্তর- দাঁড়ান দাদা, বিরাট খেলছে। ম্যাচটা জিতে যাই। তারপর স্টার্ট দিচ্ছি। ৯০,০০০ দর্শকের চোখে-মুখে তখন নিজের দেশকে জেতানোর প্রবল ইচ্ছে। শেষমেশ ব্যাট চালালেন অশ্বিন। এক মুহূর্তেই যেন পুরো ছবিটা বদলে গেল। ওই দূরে লাল টুপি পরে বাচ্চাদের মতো সমানে লাফিয়ে চলেছেন সুনীল গাভাস্কার। ইরফান পাঠানের মুখে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দ। ততক্ষণে ২২ গজের দিকে দৌড় দিয়েছেন সূর্য, কার্তিক, হার্দিকরা। আর বিরাটের চোখে জল। বাকিটা ইতিহাস।
১০ ওভার শেষে ভারতের স্কোর তখন ৪ উইকেট হারিয়ে ৪৫। ম্যাচ জেতা প্রায় অসম্ভব। ক্রিজে কোহলি ও হার্দিক। দুজনের ওপরই ভরসা আছে। তবে পাকিস্তানের বোলিং নিয়ে বুকের মধ্যে একটা ভয়ও কাজ করছিল। ১২ ওভারে নওয়াজের বলে ছক্কা মেরে খানিকটা ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করলেন হার্দিক পান্ডিয়া। ভারতের ইনিংসের প্রথম ছয়। বোধহয় এই ছক্কাই বুঝিয়ে দেয় এখনও সবটা শেষ হয়ে যায়নি। এরপর নওয়াজের ওভারের চতুর্থ বলেই বিরাটের ব্যাট থেকে ছয়। সেই অনুভূতি বলে বোঝানো দায়। ১৫ ওভারে ১০০ ছুঁল ভারত। জয়ের জন্য দরকার ৩০ বলে ৬০ রান। অপেক্ষাকৃত স্লো। তবে অর্ধশতরানের দিকে এগোচ্ছেন বিরাট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখান থেকে যদি কেউ ম্যাচ জেতাতে পারে তাহলে সেটা বিরাটই। শাহিন আফ্রিদিকে চার মেরে অর্ধশতরান পূর্ণ করলেন বিরাট কোহলি। ৪৩ বলে এল অর্ধশতরান।
কিন্তু এখন বোধহয় উল্লাসের সময় নয়। ক্রমেই চড়ছে উত্তেজনার পারদ। অনেকটা সংশয়, চিন্তা আর জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। জয়ের জন্য শেষ ৬ বলে ১৬ রান প্রয়োজন ভারতের। ক্রিজে তখন বিরাট-হার্দিক। কিছুটা হলেও চাপমুক্ত ভারতীয় শিবির। কিন্তু সেই তৃপ্তি বোধহয় ক্ষণিকের ছিল। শেষ ওভারের প্রথম বলে আউট হার্দিক পান্ডিয়া। গ্যালারিতে উত্তেজনায় ফুটতে থাকা মুখগুলো যেন আচমকা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সতীর্থরাও চিন্তায় নখ কাটছিলেন। মাঠে ফিনিশার দীনেশকে দেখে ফের আশায় বুক বেঁধেছে সকলকে। ৩ বলে তখন ১৩ রান দরকার। শেষ ওভারের তৃতীয় বলে বিরাটের ছক্কা। এই শেষ ওভারটায় যেন ওয়াইড, নো, ফ্রি-হিট মিস যাবতীয় নাটকীয়তা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ কী ! দেখতে দেখতে কার্তিকও আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরছেন। পরের বল ওয়াইড। খানিকটা স্বস্তি। তবে জেতার খিদে তখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। উইকেট কামড়ে পড়ে থাকা কোহলি তখন একদৃষ্টিতে চেয়ে। অশ্বিনের ব্যাট ঘোরানোর পর বাকিটা সত্যিই ইতিহাস।
ম্যাচ শেষে অনেক প্রশংসা, সমালোচনা, পরিসংখ্যান আর বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এখনও চলছে। কোহলি ব়্যাঙ্কিংয়ে উপরে উঠলেন। নতুন রেকর্ড তৈরি হল। তবে ভোলা গেল না কিছু দৃশ্য। ভোলা গেল না কিং কোহলির চোখের জল। ভোলা গেল না রোহিতের বিরাটকে কাঁধে তুলে নেওয়ার দৃশ্য। ভোলা গেল না সুনীল গাভাস্কারের বাচ্চাদের মতো লাফানো।। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে যাবে। পরিসংখ্যানগুলো ঠিকঠাক মনে পড়বে হয় না তো। থেকে যাবে এই আবেগগুলো। এই অনুভূতিগুলো। আর এক নাছোড়বান্দা যোদ্ধাকে। বিরাট কোহলি।