আজও রহস্য পাখিদের গণহত্যার এই গ্রাম
নানা ব্যাখ্যা আর অজানা রহস্য বুকে আঁকড়ে ধরে নীরবে কালাতিপাত করছে এই গ্রাম। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা । আর এই সৌন্দর্যের পিছনেই একটা নির্মম রহস্য লুকিয়ে। লোক বলে এই গ্রাম না কি পাখিদের মৃত্যু উপত্যকা। খুব একটা ভুলও নয় বিষয়টি। কারণ প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই গ্রামের পথ-ঘাট ঢেকে যায় পরিযায়ী পাখিদের লাশে। কিন্তু কেন এরকম হয় তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অসমের দিমা হাসাও জেলার পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত জাতিঙ্গা গ্রাম। প্রায় ২,৫০০ আদিবাসী মানুষের বসবাস এখানে। এই গ্রামের সৌন্দর্য নজর কাড়তে বাধ্য। কিন্তু প্রতিবছরই এখানে ঘটে এক রহস্যজনক কাণ্ড। প্রতিবছর সাধারণত বর্ষার শেষ থেকে সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এই ঘটনাটি ঘটে। এই সময় এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি আসে। আর সকাল বেলায় পাখিদের লাশে ঢেকে যায় পুরো এলাকা। গ্রামবাসীরাও বুঝতে পারেন না রাতের অন্ধকারে এমন কী হয়, যে এভাবে পাখিদের মৃত্যু হয়। গ্রামের কেউ কেউ বলে এটা পাখিদের আত্মহত্যা নয়, এর পিছনে প্রেতাত্মাদের হাত রয়েছে। এই গ্রামে শয়তানের প্রভাবে এই ঘটনা ঘটে। শয়তান বলি নেয় পাখিদের। তারা আরও জানাচ্ছে, এই সময় গাঁয়ের আকাশে প্রেতাত্মারা উড়ে বেড়ায়। আর পাখিদের মাটিতে ছুড়ে ফেলে।
এই ঘটনা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বহু কারণও দেখানো হয়েছে। পক্ষীতত্ত্ববিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু পাখিদের মস্তিষ্ক এতটাও উন্নত নয়, যে তারা আত্মহত্যা করতে পারে। তাহলে এই এলাকায় এসে পাখিরা এভাবে মারা যায় কেন? অনেকে বলেন, যেহেতু বর্ষার শেষ থেকে সেপ্টেম্বর এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে, তাই এধরনের ঘটনা ঘটে। কারণ এই সময়টায় ঘন কুয়াশা, ধোঁয়াশা কিংবা মেঘ থাকে। পরিযায়ী পাখিরা একটা গতিতে থাকে, আর অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে গাছে, বাঁশে কিংবা অন্যত্র ধাক্কা খেয়ে প্রাণ হারায়। তাই এই গণ আত্মহত্যা।
কিন্তু এই সন্ধের সময়টা তো পাখিদের বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেওয়ার সময়। তাই এখন পাখিদের এভাবে মৃত্যু নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে পাখি বিশেষজ্ঞরা আরও একটি যুক্তি খাড়া করেছেন। তাঁদের কথায়, বর্ষার শেষের দিকে প্রায় সময় অসমের এই অঞ্চলগুলি প্লাবিত হয়। তখন পাখিরা তাদের বাসস্থান হারায়। ফলে তারা অন্যত্র পাড়ি দেয়। আর তা করতে গিয়েই রাতের অন্ধকারে আলোক উৎস যেমন আগুনের মশাল কিংবা ওয়াচ টাওয়ারের ফ্লাড লাইটের আলো দেখে এরা বিক্ষিপ্ত আচরণ শুরু করে। তাদের যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অনেকটা মাতালদের মতো টলতে টলতে উড়তে থাকে আর সজোরে ধাক্কা মারে জাতিঙ্গার গাছ-পালা বা অন্যকিছুতে। তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে আছড়ে পড়ে মাটিতে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় না কি এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। গবেষকরা জানাচ্ছেন এই গণহত্যার তালিকায় নাম লেখায় প্রায় ৪৪ প্রজাতির পাখি।
অনেকে বলেন, জাতিঙ্গার অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে জলাশয়ের নিচের স্তরে এক চৌম্বকীয় পরিবেশে তৈরি হয়। এর জেরে পাখিরা অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। এই ঘটনা ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াতেও দেখা যায়।
এই সমস্ত ব্যাখ্যা যে যার নিজস্ব । কিন্তু এখনও রাতের অন্ধকার আর ঘন কুয়াশার চাদরে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয় জাতিঙ্গায়। যা প্রাণ কাড়ে হাজার হাজার পাখির। যার যথাযত কারণ খুঁজে বের করতে বোধহয় এখনও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যা আপাতত রহস্য।