হাসিনা শাসনের সমাপ্তি, কেন এই পরিস্থিতি ?
শেষপর্যন্ত জয় হল বিক্ষোভকারী জনতার। বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা বাধ্য হলেন দেশ ছাড়তে। আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে জানালেন সেনাপ্রধান। দেশবাসীকে শান্ত হওয়ায় এবং সহযোগিতার অনুরোধ করলেন তিনি।
কিন্তু কিভাবে শুরু হয় আন্দোলন?
১৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলেমেয়েদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ৩০ শতাংশ কোটা। তারসঙ্গে বিভিন্ন কোটা যোগ করে ৫৬ শতাংশ আসনই ছিল সংরক্ষিত। এর ফলে বাড়ছিল বেকারত্ব। ক্রমবর্ধমান এই বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের ভিতরে জমছিল ক্ষোভ।
ফলত ২০১৮ সালে প্রথমবার কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে ছাত্ররা। আন্দোলনের মুখে পড়ে সব ধরনের কোটা তুলে নেওয়ার হটকারী সিদ্ধান্ত নেয় হাসিনা সরকার। তাতে আন্দোলন থেমে গেলেও শুরু হয় নয়া বিপত্তি। এই বছরের জুনে, হাসিনার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়রা। মামলার ফলাফলে কোর্ট সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে কোটা পুনর্বহাল করে। এই রায়ের পরই আবার শুরু হয় আন্দোলন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন
আন্দোলনের শুরু জুলাই মাসের ১৫ তারিখ। সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয় আন্দোলন। পরে তা হিংসাত্মক আকার ধারন করে। আন্দোলন ঠেকাতে নামে পুলিশ, আর্মি। বন্ধ করে দেওয়া হয় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেটও। ছাত্রদের উপর চালানো হয় গুলি। সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারী ছাত্র এবং আওয়ামী ছাত্রলীগের সদস্যেদের মধ্যেও। মৃত্যু হয় কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর।
পরে ছাত্রছাত্রীদের দাবীকে মান্যতা দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ শেয়ার সিট মেধাভিত্তিক বরাদ্দ হবে রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত এবং ৭ শতাংশ সিট থাকবে সংরক্ষিত। তারপর আন্দোলন কিছুটা থিতিয়ে যায়।
তাহলে কেন আবার শুরু হয় আন্দোলন?
গত মাসে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু করে বাংলাদেশের ছাত্ররা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেই অবস্থা কিছু থিতিয়ে এলে আগের সপ্তাহ থেকে আবার উত্তপ্ত হয় বাংলাদেশ। আন্দোলনে হওয়া হিংসার জন্য শেখ হাসিনার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া, ইন্টারনেট সংযোগ পুনঃস্থাপন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুনরায় চালু এবং যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মুক্তি এরকম নয় দফা দাবিতে আবার রাস্তায় নামে ছাত্ররা। এই আন্দোলন রুখতে কড়া পদক্ষেপ নেয় সরকার। যার জেরে রবিবার পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ছাত্রদলের মধ্যে বাঁধে সংঘর্ষ। মৃত্যু হয় ১০০ জনেরও বেশি। এরপরই আন্দোলন হাসিনা হঠাও আন্দোলনে পরিণত হয়।
গত সোমবার সরকারের জারি করা কারফিউ অমান্য করেই “মার্চ টু ঢাকা” র আহ্বান জানিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। সেই ডাকেই হাজারে হাজারে মানুষ ঢাকাতে জড়ো হন ঢাকায়। তারপরই আসে হাসিনার ইস্তফার খবর। দলে দলে মানুষ ঢুকে পড়েন গণভবনে। শুরু হয় ভাঙচুর, লুটপাট। রাস্তায় হর্ষ উল্লাসে মিছিল করতে থাকে মানুষ। শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও করে আন্দোলনকারীরা। তারসঙ্গে আওয়ামী লীগের জেলা কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনেও।
কিন্ত কেন হাসিনার পদত্যাগের দাবি চেয়ে আন্দোলন করছিল বিক্ষোভকারীরা?
জুলাই মাসের কোটা সংস্কারের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ সরকারের ছাত্রছাত্রীদের উপর আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে মৃত্যুভূমিতে পরিনত করে তোলে। মৃত্যু হয় প্রায় ৩০০ জনের। এর সঙ্গে জুলাই মাসের আন্দোলনের সময় হাসিনার ”মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” এই মন্তব্যই আগুনে ঘি ঢালে। পরে যদিও তিনি বলেন তার কথাকে বিকৃত করে বলা হয়েছে। ছাত্রদের তিনি রাজাকার বলেননি। কিন্তু পরিস্থিতি তখন হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। পরে হাসিনা সরকার আলোচনায় বসতে চাইলেও তা প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা।
এরপর গত সপ্তাহের নয় দফা দাবির আন্দোলনের আবারও পরিস্থিতি কড়াভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয় হাসিনা সরকার। শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন যারা আন্দোলন করছে তারা তাঁরা ছাত্র নয় “সন্ত্রাসবাদী”, দেশকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। তাঁর কথায় বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াতে-ইসলামীর লোকেরাই এইসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের প্রতি সরকারের এই বিরূপ মনোভাবই ছাত্র আন্দোলনকে ‘হাসিনা গোদি ছাড়ো’ আন্দোলনে পরিণত করে বলে মনে করা হচ্ছে।