একসময় এখানেই পুজোর পুষ্পাঞ্জলি দিতেন নেতাজি, চলত স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈঠক

কালের নিয়মে এখন সবই ইতিহাস। শুধু সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিতে ছিটেফোঁটা বেঁচে। সরকারের তরফে হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করা হয়েছে। চারিদিক সুভাষচন্দ্র বসুর নামে নামকরণ হয়েছে। তবে সবকিছুর মধ্যে কোথাও যেন অযত্নে থেকে গেছে সুভাষের পৈতৃক ভিটে। অবেহলায় চাপা পড়ে গেছে বহু ইতিহাস। যার চর্চা, সমাদর বোধহয় জরুরি ছিল।

সোনারপুর লোকাল লাইনে সুভাষগ্রাম পরিচিত নাম। তবে সুভাষ জড়িয়ে রয়েছে কোদালিয়া গ্রামের সবুজ প্রান্তরে, বাগানবাড়িতে কিংবা ওই বড় দুর্গা দালানের আড্ডায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোদালিয়া কলকাতা থেকে ২৬-২৮ কিলোমিটার হবে। এখানেই রয়েছে সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক বাড়ি। এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছেন সুভাষ। কেটেছে শৈশবের বহু দিন।

আপাতত কেয়ারটেকারের ভরসায় দাঁড়িয়ে সুভাষ স্মৃতি। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন থাকে আর কি। দোতলা বাড়ি। নড়বড়ে দরজা-জানালা। দেওয়াল, কড়ি-বরগা, টালির চাল কিংবা ইট-বিছানো পথ, সর্বত্র বয়সের ছাপ। ঘরগুলোর মধ্যে খাট, কাঠের চেয়ার, আলমারি, টেবিল ইত্যাদি এখনও বর্তমান। তবে ইতিহাস আর স্মৃতির ভারবহনে তাদেরও অবস্থা খারাপ। দোতলা থেকে সামনের বাগানবাড়ি দেখা যায়। পাশের গোলাঘরটাও আছে নিজের মতো করে। সুভাষচন্দ্রের বাড়ির অনতিদূরে দুর্গাবাড়ি। হয়তো অভ্যেসে পুজোও হয় ।

এবার ফেরা যাক এই সব এলোমেলো আসবাবপত্র, ঘর-বাড়ির ইতিহাসে। সুভাষের অসমাপ্ত আত্মজীবনী এন ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম (১৯৯৭)-এ নিজের পরিবারের প্রায় ২৭ প্রজন্মের কথা বলছিলেন সুভাষ। সেখান থেকে জানা যায় বসু পরিবারের প্রায় ১০ প্রজন্ম বসবাস করেছিলেন এই কোদালিয়ায়। দশরথ বসু ছিলেন এদের মধ্যে একাদশতম প্রজন্ম। এরপর মহীপতি বসু। ষোলো-সতেরো শতকের শুরুর দিক। তৎকালীন বাংলায় সুলতান-নবাবদের রাজ। এই মহীপতি বসুর নাতি গোপীনাথ বসু বাংলার সুলতান হোসেন শাহর অর্থমন্ত্রক এবং নৌসেনার দায়িত্ব সামলেছেন। শোনা যায়, গোপীনাথের কাজে খুশি হয়ে তাঁকে পুরন্দর খানের উপাধি দেন সুলতান। সঙ্গে উপহার স্বরূপ একটা জাগির। অর্থাৎ একটি জায়গা দেওয়া হয়। যেটা পুরন্দরপুর নামে পরিচিত ছিল। প্রথমে সেখানে বসবাস শুরু করেন গোপীনাথ বসু। কিন্তু কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রতিবেশী গ্রাম কোদালিয়ায় চলে আসেন। সেই থেকে শুরু। ১৭৬০ সালে কোদালিয়ায় দশ কাঠা জমির উপর একটি বাড়ি তৈরি হয়েছিল। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়। সুভাষচন্দ্রের পিতামহ হরনাথ বসুও সেখানে থাকতেন। চার ছেলে নিয়ে ভরা সংসার।

এর মাঝেই ১৮৮০ সালে হরনাথ পুত্র জানকিনাথের প্রভাবতী দত্তের সঙ্গে বিবাহ হয়। পরে কটক চলে যান জানকীনাথ। সেখানে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৭ বছর পর ১৮৯৭ সালে ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্ম। ১৯০৯ সালে এলগিন রোডে বাড়ি করলেন জানকীনাথ। সেই বাড়ি ঘিরেই সুভাষের একাধিক কর্মকাণ্ড। ১৯৪০ সালে গৃহবন্দী হলেন। অন্তর্ধানও এখান থেকে। কিন্তু এর মাঝেও কোদালিয়ায় বেড়ে উঠেছে বহু স্মৃতি। তার সবেচেয়ে বেশি বোধহয় বসু পরিবারের দুর্গাপুজো ঘিরে।

বসু পরিবারের ঘরগুলির দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল দুর্গা দালানটি। তার দক্ষিণে বড় পুকুর। দালালের বড় বড় স্তম্ভ এখন ক্ষয়প্রাপ্ত। তবে একসময় বহু আড্ডার সাক্ষী। দুর্গাপুজোর সময়টা বসু পরিবারের প্রত্যেকে দেশ-বিদেশ থেকে এসে এক জায়গায় জড়ো হতেন। শুধু দুর্গাপুজো নয় লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজোও হত। এই পুজো নেতাজির কাছে যে খুব প্রিয় ছিল তারও বহু প্রমাণৃ রয়েছে। একবার মান্দালয় সেন্ট্রাল জেল থেকে দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে দুর্গাপুজো নিয়ে চিঠি লেখেন সুভাষ। সেই চিঠিতে নানা স্মৃতি ভিড় করেছিল। কয়েকশো বছরের পুরোনো বসু পরিবারের এই দুর্গাপুজোতে নবমীর দিন বলি হত। শোনা যায় হরনাথ বসুর আমলে তুলে দেওয়া হয় বলিপ্রথা। পুজোর সময় সুভাষকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আসতেন জানকীনাথ। গ্রামবাসীর জন্য নানা উপহার নিয়ে আসেতন তিনি। সুভাষের পরবর্তী প্রজন্মদের স্মৃতিচারণে এইরকম নানা তথ্য মেলে। পুজোর চারদিন গ্রামের লোকজনের খাওয়া-দাওয়া চলত এখানে। রোজ সন্ধ্যায় কত আসর। কত আড্ডা।

তবে শুধু পুজো নয়। সুভাষ বড় হওয়ার পরও কোদালিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৪ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস গ্রাম পরিকাঠামো উন্নয়নের কর্মসূচি নেন। এই আহ্বানে সাড়া দেন নেতাজি ও তাঁর দাদা। কোদালিয়ায় লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে ওঠে বসু পরিবারের সহযোগিতায়। পরের দিকে একবার কোদালিয়ার নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় সুভাষ বসুকে। তার প্রমাণ মেলে সুভাষকে পাঠানো দাদা শরৎ বসুর চিঠিতে। শোনা যায়, বসু পরিবারের ওই দক্ষিণের পুকুর পাড়ে এলাকা উন্নয়ন, স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু মিটিং-বৈঠক হয়েছে একসময়। তবে আজ তা বিস্মৃত ইতিহাস।

কোদালিয়া কখনও ভুলতে পারেননি সুভাষ। শৈশবের স্মৃতি, কোদালিয়ার দিনগুলো বারবার টানত তাঁকে। এরও বহু প্রমাণ রয়েছে। ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মান্দালয় সেন্ট্রাল জেল থেকে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের অনাথবন্ধু দত্তক চিঠি লিখলেন। সেই চিঠিতেও বাংলার নদী-মাঠ-ঘাট-ক্ষেত, কোদালিয়ার অপূর্ব সৌন্দর্য সমস্ত কিছুর কথা উল্লেখ করেছিলেন সুভাষ। বিশেষ করে সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রার্থনা, প্রদীপ জ্বালানো, গ্রামের গরুর গাড়ি ।

এখনও নিজের বার্ধক্যকে সঙ্গী করে কোদালিয়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সুভাষের পৈতৃক ভিটে। এবার কোরোনা পরিস্থিতি আর নিম্নচাপের বৃষ্টির মাঝে স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনের আয়োজন করা হয়েছিল। মাঝেসাঝে সুভাষ বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে হয়তো কেউ সুভাষের কথাও মনে করে। তবে এখন সবই ইতিহাস আর অবসরের স্মৃতিচারণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.