আপোষহীন কলমের খোঁচায় আজীবন কল্পনার পর্দা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা, দরজায় কড়া নাড়ল নোবেল
উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের ছোট্ট শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তবে ফরাসি সাহিত্যের মুখস্ত পথে পা বাড়াননি। সাহসী লেখনীকে অবলম্বন করে কল্পনা, রোম্যান্টিসিজম থেকে বেরিয়ে বাস্তবের মাটিতে পা রেখেছেন। ব্যক্তি জীবন, ওঠা-পড়া, একান্তে গুছিয়ে রাখা স্মৃতিগুলোকে নাড়াচাড়া করতে করতে তৈরি করেছেন এক নিজস্ব জগৎ। যা তথাকথিত সমাজকে উপেক্ষা করে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে নিজের মধ্য জমানো কথাগুলোকে। যা সহজেই ছুঁয়ে যায় পাঠক হৃদয়কে। দশকের পর দশক ধরে জারি সেই প্রচেষ্টাকেই এবার কুর্নিশ জানাল নোবেল কমিটি। সাহিত্যে নোবেল পেলেন ফরাসি লেখিকা অ্যানি এরনো।
আধুনিক সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার পর সাতের দশকে অধ্যাপনার কাজ শুরু। পরের দিকে লেখালেখিতে হাত পাকানোর চেষ্টা। প্রথম উপন্যাস লে আরমোয়ার ভিদ রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয়। সাহসী কন্ঠস্বরকে খুব সহজেই চিনে ফেলে তৎকালীন পাঠক সমাজ। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন, কিশোরী বয়সে নানা বেপরোয়া সিদ্ধান্ত ইত্যাদি একাধিক ব্যক্তিগত ছোটো ছোটো বিষয়ের আড়ালে সমাজকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেন অ্যানি। লা প্লাস নামে আর এক উপন্যাস ফরাসি লেখক সমাজে তাঁকে পরিচিতি দেয়। সেই শুরু। কখনও বাবা, কখনও মা, কখনও বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সমাজচিত্র। আপন লেখনী গুণে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অ্যানি।
আত্মজীবনী ধর্মী সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অ্যানির সেরা সৃষ্টি বোধহয় আ গার্লস স্টোরি। লিখতে লিখতে নিজের স্মৃতির অতলে হারিয়েছেন। কখনও একটু থেমে নিজের স্মৃতি, অতীতে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর কাঁধ ঝাঁকানি দিয়ে অনেক কিছু বলতে চেয়েছেন। এক তরুণীর যৌনসম্পর্ক, নিজস্ব উপলব্ধি, সমাজের উপহাস, তার বদলে যাওয়া জীবনের আড়ালে সযত্নে রেখে গেছেন অনেককিছু। যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে।
নোবেল কমিটির তরফে করা ট্যুইটের কয়েকটি লাইনে বোধহয় অ্যানির লেখক সত্ত্বার যথার্থ মূল্যায়ণ করা যেতে পারে। লেখিকার বক্তব্যকেই তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। তাঁর কথায়, ” লেখালেখি হল রাজনৈতিক কাজ। যা সামাজিক বৈষম্যকে দেখতে সাহায্য করে। আমাদের চোখ খুলে দেয়।” বোধহয়, সেইজন্য ভাষাকে ছুরির মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। কল্পনার পর্দা ছিঁড়ে ফেলে ফুটিয়ে তুলেছেন বাস্তবের নির্মম সত্যকে। তাঁর বিশ্বাস-অবিশ্বাস, নিজের স্মৃতি, ব্যক্তি জীবন, সিদ্ধান্ত সবকিছুই যেন বারবার প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। লেখার মধ্যেই মেলাতে চেয়েছে একাধিক হিসেব-নিকেষ।
জীবন সায়াহ্নে এসে এখনও জারি সেই আপোষহীন সংগ্রাম। সত্যি বলতে, ক্লান্তির সুযোগ নেই। কারণ ফরাসি রোম্যান্টিসিজমের মাটি থেকে বহু ক্রোশ দূরে গিয়ে দশকের পর দশক ধরে নিজস্ব এক ঘরানা গড়ে তুলেছেন এই লেখিকা। কল্পনার কলমকে বাস্তবের সঙ্গে এক করে দিয়েছেন। নোবেল হয়তো সেই প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে, এই ঘরানা এত সহজে মুছে যাওয়ার নয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে থেকে যাবে। অন্য কোনও কলমে, পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তে, অন্য এক এরনোর জন্ম দেবে।