নেতাজি, বাঙালির বুক চিরে বেরিয়ে আসা এক সিংহনাদ
কেটে গেছে ১২৫ বছর। আজকাল বাঙালি বেঁচে মানিয়ে নেওয়ার জীবনে। মেরুদণ্ড একটু নোয়ালে ক্ষতি কী ? যদি তাতেই কাজ হয়ে যায়। চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট কথা বলার সাহস আজকাল প্রায় ভুলতে বসেছে সমাজ। কিন্তু আজ থেকে ঠিক ১২৫ বছর আগে বাঙালির বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক সিংহনাদ। সুভাষ। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।
উনিশ শতাব্দীর শেষের দিক। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতবর্ষ। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত ভারতবাসীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন দাসত্ব করার প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছিল। আপোষেই বাঁচতে শিখছিল মানুষজন। ২৩ শে জানুয়ারি, ১৮৯৭। ঠিক এমন সময় জন্ম নেন নেতাজি। জানকীনাথ ও প্রভাবতীর পরিবারে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে ছোট্ট সুভাষ।
ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। স্কুলের পড়াশোনা কটক থেকেই করেন। পরের দিকে কলকাতায় চলে আসেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে সিভিল সার্ভিস নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রীতিমতো ব়্যাঙ্ক করে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। কিন্তু সুভাষকে বেঁধে রাখার সামর্থ্য ছিল না ব্রিটিশ সরকারের এই চাকরিতে।
১৯২১ সালে চাকরি ছেড়ে দেন। যোগ দেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। শুরুর দিকে কলকাতায় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন তিনি। চিত্তরঞ্জন দাসের জায়গায় কাজ শুরু করেন। তাঁকেই রাজনৈতিক গুরু মনে করতেন। ক্রমে কলকাতার যুব সমাজের কাছে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের পাত্র হয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য়, চিরকালই বহুক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দকে অনুসরণ করেছেন তিনি। কিন্তু, সুভাষের দৃঢ় চোখ যে স্বরাজ ছিনিয়ে নিতে চায়। তা শুরু থেকে বোঝা যাচ্ছিল।
ইতিহাস সাক্ষী। নেতাজি ও গান্ধিজির বিচারধারা ও বিশ্বাস আলাদা ছিল। ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের অধ্যক্ষের পদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তার বিপক্ষে গান্ধীজি সিতারামাইয়া পট্টভিকে মনোনীত করেন। কিন্তু নেতাজির কাছে নির্বাচনে হেরে যান। পরে সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা বিচার করে অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেন নেতাজি। শেষমেশ কংগ্রেস ছেড়ে দেন। সত্যি বলতে সুভাষকে বোঝা শক্ত। এ যেন বাংলার গর্ভ থেকে উঠে আসা ভারত কাঁপানো এক সিংহনাদ।
১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। নেতাজি মনে করেন, এটাই সবথেকে উপযুক্ত সময় ইংরেজদের উপর আক্রমণ করার। শুরু হয় প্রস্তুতি। ব্রিটিশ সরকারও তার ইঙ্গিত পায়। কারাগারে বন্দি করে রাখা হয় বোসকে। এদিকে কারাগারে থাকাকালীন দু’সপ্তাহ ধরে অন্নজল গ্রহণ করেননি তিনি। ধীরে ধীরে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। আর তাঁর এই অবস্থা দেখে সুভাষের মুক্তির দাবিতে স্লোগান ওঠেন। এরপর ব্রিটিশ সরকার নেতাজিকে কলকাতার বাড়িতে নজরবন্দি থাকার নির্দেশ দেয়।
ছদ্মবেশ। তাকে ধরতে বারবার বেগ পেতে হত ব্রিটিশ সরকারকে। কলকাতায় নজরবন্দি হওয়ার পর এক আত্মীয়ের সাহায্য়েই ছদ্মবেশে পলায়ন করেন নেতাজি। প্রথমে বিহারে, তারপর পাকিস্তানের পেশোয়ারে। সেখান থেকে রাশিয়া হয়ে পাড়ি দেন জার্মানিতে। নেতাজির ভাই ছাড়া আর কেউ জানত না তিনি কোথায় গিয়েছেন। গান্ধীজি, নেহরু, ইংরেজরাও চিন্তিত ছিল নেতাজির পলায়ন নিয়ে।
আজাদ হিন্দ ফৌজ। তোমরা আমাকে রক্ত দাও। আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। এ এক সেনানায়ক আর তার সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস। অক্লান্ত পরিশ্রম, চেষ্টা আর স্বাধীনতার অদম্য ইচ্ছে থেকেই জন্ম নেয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। পরের দিকে রাশিয়া পাড়ি দেন। প্রসঙ্গত নেতাজির জীবনে রাসবিহারী বোসের নামও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি ভারতের বাইরে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। পরবর্তীকালে নেতাজির হাতে সেনার পরিচালন ভার তুলে দেন ৷
বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক স্তরের রাজনীতি ও কূটনীতিতেও সমান দক্ষ ছিলেন এই বাঙালি সন্তান। রাশিয়ায় গিয়ে নেতাজি জোসেফ স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করেন। পরে জার্মানির উদ্দেশে পাড়ি দেন। দেখা করেন বিশ্বত্রাসী হিটলারের সঙ্গে। কিন্তু একের পর এক বাধা আসতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালে হিটলারের মৃত্যু হয়। জার্মানির নাৎজি সৈন্য মিত্র রাষ্ট্রদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। হিরোশিমা ও নাগাশাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা হয়। পরবর্তী রণনীতি নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান নেতাজি।
১৯৪৫ সালের ১৭ অগাস্ট। INA-র বিমান চড়ে ব্য়াঙ্কক থেকে রওনা দিলেন। সঙ্গে ছিলেন কর্নেল প্রীতম সিং, দেবনাথ গুজরাল সিং, রহমান, আবির হোসেনরা। নিয়তি বোধহয় অন্যকিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল। পরে কর্নেল হাবিবুর রহমানকে নিয়ে জাপানি যুদ্ধবিমানে ওঠেন। না আর ঘরে ফেরেনি সুভাষ।
আরও পড়ুন :
এরপর জট বেঁধেছে একের পর এক রহস্য। সুভাষের মৃত্যুর বিষয়টি যেন কোনও ঘন কুয়াশায় ক্রমে হারিয়ে যায়। একের পর এক খবর ছড়াতে থাকে আর বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে।ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, ব্রিটিশ সরকার থেকে শুরু করে অ্যামেরিকা। সর্বত্র শুরু হয় সুভাষের মৃত্যুর সত্য়তা যাচাইয়ের কাজ। একের পর এক কমিশন গঠিত হয়। শাহনবাজ কমিশন, গোসলা কমিশন, মুখার্জি কমিশন। ঘনীভূত হয় গুমনামী বাবার রহস্য। না সুভাষ আর ঘরে ফেরেনি।
তবুও তিনি থেকে গেছেন। থেকে গেছেন মেরুদণ্ড সোজা করে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসে। থেকে গেছেন নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে। থেকে গেছেন আপামর ভারতীয়র বুকে।